চুল পড়ার অন্যতম কারণ খুশকি
চুল পড়ার সমাধানের পূর্বে আমাদের জানতে হবে যে এই সমস্যার কারনটা আসলে কি? ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস তাদের এক প্রতিবেদনে চুল পড়ার কারনসমূহের মধ্যে হরমোনের পরিবর্তন, বার্ধক্য, ইমিউন সিস্টেমের ব্যাধির পাশাপাশি খুশকির একটি পরোক্ষ প্রভাব উল্লেখ করেছে।
Max Multi Speciality Centre এর সিনিয়র কনসালটেন্ট ডার্মাটোলজিস্ট ডাঃ অরভিন্দ এর মতে খুশকি হলে মাথার ত্বকে শুষ্কতা ও চুলকানি তৈরি হয়, যা চুলের গোড়া দুর্বল করে ফেলে। বিশেষত, যদি এই অবস্থা দীর্ঘ সময় ধরে চলতে থাকে, তবে তা চুলের স্বাভাবিক বৃদ্ধিতে ব্যাঘাত ঘটায় এবং একইসাথে এটি অতিরিক্ত চুল ঝরার কারণও হতে পারে। সুতরাং বোঝা যায় যে, চুল পড়ার প্রধান কারণগুলোর মধ্যে খুশকি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
খুশকি সাধারণত ত্বকের মেলাসেজিয়া নামক ছত্রাকের অতিবৃদ্ধির কারণে ঘটে। এছাড়া, শুষ্ক ত্বক, অতিরিক্ত তেল জমা, বা ত্বকের অ্যালার্জি জাতীয় সমস্যাগুলোর কারণেও এটি হতে পারে। এই সমস্যাটি দ্রুত সমাধান না করলে আপনার চুলের স্বাস্থ্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
খুশকি তাড়াতে ও চুল পড়া রোধে ঘরোয়া উপায়
খুশকি দূর করা এবং চুল পড়া বন্ধের উপায় হিসেবে ঘরোয়া পদ্ধতিগুলো অত্যন্ত কার্যকর ও নিরাপদ। নিচে এমন ১৫ টি উপায় বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হলো।
নারকেল তেল ও লেবুর রস
নারকেল তেল চুলের গভীরে পুষ্টি জোগায় এবং লেবুর রসে থাকা সাইট্রিক এসিড মাথার ত্বক পরিষ্কার করে। এটি মাথার ত্বকের ফাঙ্গাস দূর করতে সহায়ক। নারকেল তেলে লেবুর রস মিশিয়ে ম্যাসাজ করলে খুশকি কমে যায় এবং চুলের গোড়া শক্তিশালী হয়। নিয়মিত এই মিশ্রণ ব্যবহারে চুল পড়ার সমস্যা কমে।
মেথি বীজ
মেথি বীজে রয়েছে অ্যান্টি-ফাঙ্গাল ও অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল গুণ, যা খুশকি দূর করে। রাতে মেথি বীজ পানিতে ভিজিয়ে রেখে সকালে পেস্ট তৈরি করে মাথার ত্বকে লাগিয়ে ৩০ মিনিট রেখে ধুয়ে ফেলুন। এটি চুল পড়া রোধ করে এবং চুলের স্বাভাবিক বৃদ্ধি নিশ্চিত করে।
অ্যালোভেরা জেল
অ্যালোভেরা জেল মাথার ত্বককে শীতল রাখে এবং খুশকি কমায়। এটি মাথার ত্বকের শুষ্কতা দূর করে এবং নতুন চুল গজাতে সাহায্য করে। তাজা অ্যালোভেরা জেল মাথার ত্বকে লাগিয়ে ২০ মিনিট রেখে ধুয়ে নিলে ভালো ফল পাওয়া যায়।
পেঁয়াজের রস
পেঁয়াজের রসে সালফার আছে, যা চুলের গোড়াকে মজবুত করে এবং খুশকি নিয়ন্ত্রণ করে। পেঁয়াজের রস মাথার ত্বকে লাগিয়ে ২০ মিনিট অপেক্ষা করার পর শ্যাম্পু দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। এটি চুল পড়া কমাতে বিশেষভাবে কার্যকর।
দই
দই একটি প্রাকৃতিক কন্ডিশনার হিসাবে কাজ করে। এটি মাথার ত্বক থেকে খুশকি দূর করে এবং চুলের স্বাস্থ্য উন্নত করে। এক কাপ দই মাথার ত্বকে লাগিয়ে ৩০ মিনিট অপেক্ষা করে ধুয়ে নিন। এটি মাথার ত্বককে ময়েশ্চারাইজ রাখে এবং চুলের গোড়া মজবুত করে।
বেকিং সোডা
বেকিং সোডা মাথার ত্বকের মৃত কোষ দূর করে এবং খুশকির বৃদ্ধি রোধ করে। এটি অল্প পানিতে মিশিয়ে পেস্ট তৈরি করে মাথার ত্বকে লাগিয়ে ১০ মিনিট রেখে ধুয়ে নিন। এটি মাথার ত্বককে পরিষ্কার ও সতেজ করে তোলে।
গ্রিন টি
গ্রিন টি একটি শক্তিশালী অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, যা মাথার ত্বকের স্বাস্থ্য রক্ষা করে। গ্রিন টি বানিয়ে ঠান্ডা করে মাথার ত্বকে ম্যাসাজ করুন এবং ২০ মিনিট অপেক্ষা করে ধুয়ে ফেলুন। এটি খুশকির পাশাপাশি চুল পড়াও কমায়।
নিমের পাতা
নিমের পাতা প্রাকৃতিক অ্যান্টি-ফাঙ্গাল এবং অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল উপাদানে সমৃদ্ধ। এটি সেদ্ধ করে পেস্ট তৈরি করে মাথার ত্বকে লাগিয়ে ৩০ মিনিট অপেক্ষা করুন। নিয়মিত ব্যবহারে এটি খুশকি দূর করে এবং চুলের গোড়াকে শক্তিশালী করে।
আপেল সিডার ভিনেগার
আপেল সিডার ভিনেগার মাথার ত্বকের পিএইচ ব্যালান্স বজায় রাখে এবং ফাঙ্গাস কমায়। এটি পানির সঙ্গে মিশিয়ে মাথার ত্বকে লাগিয়ে ১৫ মিনিট পরে ধুয়ে ফেলুন। এটি মাথার ত্বককে পরিষ্কার রাখে এবং চুল পড়া রোধ করে।
ডিমের প্যাক
ডিমের মধ্যে থাকা প্রোটিন চুলের গোড়াকে মজবুত করে। ডিমের সাদা অংশ ও লেবুর রস মিশিয়ে একটি প্যাক তৈরি করে চুলে লাগিয়ে ৩০ মিনিট রেখে ধুয়ে ফেলুন। এটি খুশকি দূর করার পাশাপাশি চুলের স্বাস্থ্য ভালো রাখে।
তুলসী পাতা ও আমলকির মিশ্রণ
তুলসী পাতা ও আমলকিতে থাকা ভিটামিন সি এবং অ্যান্টি-ফাঙ্গাল উপাদান খুশকি দূর করতে সহায়তা করে। কয়েকটি তুলসী পাতা এবং শুকনো আমলকি একসঙ্গে পেস্ট তৈরি করে মাথার ত্বকে লাগান। ৩০ মিনিট অপেক্ষা করে শ্যাম্পু দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। এই মিশ্রণ চুলের গোড়াকে শক্তিশালী করে এবং খুশকি দূর করে।
লবঙ্গের তেল
লবঙ্গের তেল মাথার ত্বকের রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি করে এবং খুশকি প্রতিরোধ করে। কয়েক ফোঁটা লবঙ্গের তেল নারকেল তেলের সঙ্গে মিশিয়ে ম্যাসাজ করুন। এটি রাতে রেখে সকালে ধুয়ে ফেলুন। নিয়মিত ব্যবহারে এটি চুল পড়ার সমস্যা কমায়।
রসুনের পেস্ট
রসুনে থাকা প্রাকৃতিক অ্যান্টি-ফাঙ্গাল উপাদান মাথার ত্বক থেকে খুশকি দূর করতে কার্যকর। কয়েকটি রসুন পিষে পেস্ট তৈরি করে মাথার ত্বকে লাগান এবং ১৫-২০ মিনিট অপেক্ষা করুন। পরে হালকা গরম পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। এটিও চুল পড়ার সমস্যা কমাতে সাহায্য করে।
মধু ও দারুচিনি
মধু মাথার ত্বককে ময়েশ্চারাইজ করে এবং দারুচিনির অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল গুণ খুশকি নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। ২ টেবিল চামচ মধু ও ১ চা চামচ দারুচিনি গুঁড়া মিশিয়ে পেস্ট তৈরি করুন। এটি মাথার ত্বকে লাগিয়ে ২০ মিনিট রেখে ধুয়ে ফেলুন।
ক্যাস্টর অয়েল
ক্যাস্টর অয়েল চুলের বৃদ্ধি বাড়ায় এবং খুশকি দূর করতে সহায়ক। ক্যাস্টর অয়েল হালকা গরম করে মাথার ত্বকে ম্যাসাজ করুন। এটি এক ঘণ্টা রেখে শ্যাম্পু দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। এই তেল চুলের গভীরে পুষ্টি জোগায় এবং খুশকির সমস্যাকে নিয়ন্ত্রণে রাখে।
প্রাকৃতিক এই উপায়গুলো নিয়মিত ব্যবহারে খুশকি এবং চুল পড়া সমস্যার স্থায়ী সমাধান পাওয়া সম্ভব।
চুল পড়া ও খুশকি দূর করার শ্যাম্পু
চুল পড়া এবং খুশকি দূর করতে সঠিক শ্যাম্পু ব্যবহার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাজারে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের শ্যাম্পু রয়েছে, যা চুলের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান দিতে পারে। সঠিক শ্যাম্পু বাছাই করে তা নিয়মিত ব্যবহারে খুশকি ও চুল পড়ার সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। তবে, চুলের ধরন ও সমস্যার ভিত্তিতে শ্যাম্পু নির্বাচন করাই ভালো। নিচে চুল পড়া এবং খুশকি দূর করতে উপযোগী এমন ৫-৭টি শ্যাম্পু নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
হেড অ্যান্ড শোল্ডারস অ্যান্টি-ড্যান্ড্রাফ শ্যাম্পু
হেড অ্যান্ড শোল্ডারস অ্যান্টি-ড্যান্ড্রাফ শ্যাম্পু খুশকি দূর করতে অন্যতম কার্যকর একটি শ্যাম্পু। এটি মাথার ত্বকের শুষ্কতা দূর করে এবং চুলকে মসৃণ করে তোলে। নিয়মিত ব্যবহারে খুশকির পাশাপাশি চুল পড়ার সমস্যাও কমে। এর বিশেষ ফর্মুলা মাথার ত্বককে পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করে।
ক্লিয়ার অ্যান্টি-ড্যান্ড্রাফ শ্যাম্পু
ক্লিয়ার অ্যান্টি-ড্যান্ড্রাফ শ্যাম্পু বিশেষভাবে তৈরি খুশকি প্রতিরোধে কার্যকর। এটি মাথার ত্বক থেকে ফাঙ্গাস এবং ব্যাকটেরিয়া দূর করে। এর নিয়মিত ব্যবহারে চুল পড়া কমে এবং চুল হয়ে ওঠে স্বাস্থ্যকর ও মজবুত।
ডাভ ডার্মা কেয়ার অ্যান্টি-ড্যান্ড্রাফ শ্যাম্পু
ডাভ ডার্মা কেয়ার শ্যাম্পু চুলের শুষ্কতা দূর করে এবং চুলকে প্রাকৃতিকভাবে মসৃণ ও মজবুত করে। এতে ব্যবহৃত ফর্মুলা মাথার ত্বকের পিএইচ ব্যালান্স বজায় রাখে এবং খুশকির সমস্যা নিয়ন্ত্রণ করে।
নিজরাল শ্যাম্পু
নিজরাল একটি মেডিকেটেড শ্যাম্পু, যা খুশকি এবং মাথার ত্বকের ফাঙ্গাল সংক্রমণ দূর করতে বিশেষভাবে কার্যকর। এটি খুশকি প্রতিরোধে দ্রুত কাজ করে এবং চুলের গোড়া শক্তিশালী করে। ডার্মাটোলজিস্টদের মধ্যে এই শ্যাম্পুটি বেশ জনপ্রিয়।
প্যান্টিন প্রো-ভি এন্টি-ড্যান্ড্রাফ শ্যাম্পু
প্যান্টিন প্রো-ভি শ্যাম্পু মাথার ত্বকের ফাঙ্গাস এবং ব্যাকটেরিয়া দূর করতে সাহায্য করে। এটি চুল পড়া প্রতিরোধ করে এবং চুলে পুষ্টি জোগায়। চুলকে স্বাস্থ্যোজ্জ্বল ও মসৃণ করার জন্য এই শ্যাম্পুটি ব্যবহারে ভালো ফল পাওয়া যায়।
সেলসান ব্লু মেডিকেটেড শ্যাম্পু
সেলসান ব্লু একটি মেডিকেটেড শ্যাম্পু, যা মূলত সেলেনিয়াম সালফাইড সমৃদ্ধ। এটি খুশকির মূল কারণগুলো দূর করে এবং মাথার ত্বককে স্বাস্থ্যকর রাখে। নিয়মিত ব্যবহারে এটি চুল পড়া রোধে কার্যকর।
হিমালয়া অ্যান্টি-ড্যান্ড্রাফ শ্যাম্পু
হিমালয়া শ্যাম্পু প্রাকৃতিক উপাদানে তৈরি, যা মাথার ত্বককে পরিষ্কার করে এবং খুশকি কমায়। এটি চুল পড়া রোধ করতে এবং চুলের স্বাভাবিক বৃদ্ধি বজায় রাখতে সাহায্য করে। প্রাকৃতিক ফর্মুলার ব্যবহার করার কারনে এটি সাধারনত সব ধরনের চুলের জন্য উপযুক্ত।
উপসংহার
চুল পড়া ও খুশকি দূর করার উপায় হিসেবে নিয়মিত চুলের যত্ন নেয়া অত্যন্ত জরুরি। খুশকি মাথার ত্বককে শুষ্ক ও অস্বাস্থ্যকর করে তোলে, যা চুলের গোড়া দুর্বল করে চুল পড়ার সমস্যা বাড়ায়। প্রাকৃতিক উপাদান যেমন নারকেল তেল, মেথি বীজ, অ্যালোভেরা, এবং পেঁয়াজের রস ব্যবহার করে সহজেই এই সমস্যা দূর করা সম্ভব।
এর পাশাপাশি, বাজারে বিভিন্ন অ্যান্টি-ড্যান্ড্রাফ শ্যাম্পু যেমন হেড অ্যান্ড শোল্ডারস, ডাভ ডার্মা কেয়ার, নিজরাল, এবং হিমালয়া খুশকি প্রতিরোধে কার্যকর। নিয়মিত চুলের যত্ন, সঠিক ডায়েট, এবং প্রাকৃতিক বা মেডিকেটেড পণ্য ব্যবহারের মাধ্যমে খুশকি এবং চুল পড়ার সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
