আধুনিক জীবনে ওজন কমানোর প্রচেষ্টার কথা আমরা অহরহ শুনি, কিন্তু কিছু মানুষ রয়েছেন যারা দ্রুত মোটা হতে চান- স্বাস্থ্যগত কারণেই হোক বা আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধির জন্য। হঠাৎ ওজন হ্রাস, শারীরিক দুর্বলতা বা প্রয়োজনের তুলনায় কম ওজন অনেকের জন্য সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাই সঠিক পদ্ধতিতে ওজন বাড়ানোর উপায় জানা অত্যন্ত জরুরি। তবে এটি শুধু বেশি খাওয়ার ওপর নির্ভর করে না; সুষম পুষ্টি, সঠিক খাদ্যাভ্যাস এবং জীবনযাত্রার পরিবর্তনের মাধ্যমেই স্বাস্থ্যকরভাবে ওজন বাড়ানো সম্ভব। এই লেখায় আমরা দ্রুত ওজন বাড়ানোর কার্যকর উপায়গুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
অনেকেই যথেষ্ট খাওয়ার পরও মোটা হতে পারেন না, যা অনেকের কাছেই হতাশার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এর পেছনে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ থাকতে পারে। প্রথমত, বংশগত কারণ বড় ভূমিকা রাখে। যদি পরিবারের সদস্যরা স্বাভাবিকভাবেই রোগা হন, তবে জেনেটিক প্রভাবের কারণে সহজে ওজন বাড়ানো যায় না।দ্বিতীয়ত, উচ্চ বিপাক হার (High Metabolism) থাকলে শরীর দ্রুত ক্যালোরি পোড়ায়, ফলে অতিরিক্ত খাবার খাওয়ার পরও তা চর্বিতে পরিণত হয় না। তৃতীয়ত, অপুষ্টি ও অনিয়মিত খাদ্যাভ্যাস ওজন না বাড়ার একটি বড় কারণ। পুষ্টিকর ও পর্যাপ্ত ক্যালোরিযুক্ত খাবার না খেলে শরীর প্রয়োজনীয় শক্তি ও পুষ্টি পায় না, যার ফলে ওজন বাড়তে পারে না। হরমোনজনিত সমস্যা যেমন থাইরয়েডের অতিসক্রিয়তা (হাইপারথাইরয়েডিজম) শরীরের বিপাক হার বাড়িয়ে দেয়, যা ওজন বাড়তে বাধা দিতে পারে।এছাড়াও, মানসিক চাপ, ঘুমের অভাব ও দীর্ঘস্থায়ী রোগ যেমন ডায়াবেটিস, পরিপাকতন্ত্রের সমস্যা বা সংক্রমণজনিত রোগ ওজন কমিয়ে দিতে পারে। সুতরাং, ওজন না বাড়ার কারণ বোঝা এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া স্বাস্থ্যকরভাবে মোটা হওয়ার প্রথম ধাপ।
ওজন বৃদ্ধির জন্য ক্যালোরি উদ্বৃত্ত থাকা প্রয়োজন—অর্থাৎ, শরীর যতটা ক্যালোরি ব্যবহার করে, তার চেয়ে বেশি ক্যালোরি গ্রহণ করা জরুরি।
যারা স্বাভাবিকভাবে মোটা হতে পারছেন না, তাদের জন্য ওজন বাড়ানোর কিছু কার্যকর কৌশল অনুসরণ করা জরুরি। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে, ওজন বাড়ানোর প্রক্রিয়া যেন স্বাস্থ্যকর হয় এবং শরীরে অতিরিক্ত চর্বি জমিয়ে সমস্যার সৃষ্টি না করে। নিচে কিছু কার্যকর উপায় উল্লেখ করা হলো-
প্রতিদিন প্রয়োজনের তুলনায় ৫০০ থেকে ১০০০ ক্যালোরি বেশি গ্রহণ করলে দ্রুত ওজন বাড়ে। ভাত, রুটি, আলু, বাদাম, চকলেট, মাখন ও দুগ্ধজাত খাবার বেশি পরিমাণে খেলে ক্যালোরি দ্রুত বৃদ্ধি পায়।
ওজন বাড়ানোর সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো প্রোটিন গ্রহণ করা। মাছ, মাংস, ডিম, ডাল, দুধ, দই, ছানা, বাদাম এবং সয়াবিন নিয়মিত খেলে পেশি বৃদ্ধি পায় এবং শরীর দ্রুত মোটা হয়।
প্রতিদিন ৩ বেলার পরিবর্তে ৫-৬ বার খাবার খাওয়ার অভ্যাস করুন। ছোট ছোট মিল গ্রহণ করলে শরীর সহজে পুষ্টি শোষণ করতে পারে এবং দ্রুত ওজন বাড়ে।
কলা, দুধ, মধু ও বাদাম দিয়ে মিল্কশেক তৈরি করে খেলে দ্রুত ওজন বাড়ে। খেজুর, দুধ ও মধু মিশিয়ে ব্লেন্ড করে পান করলে শরীরে শক্তি বৃদ্ধি পায় এবং ওজন বাড়ে। এছাড়া আম ও দুধ একসঙ্গে খেলেও ক্যালোরি বৃদ্ধি পায়।
ইসলামে সুস্থ দেহ ও মনের গুরুত্ব অনেক বেশি। শরীরকে আল্লাহর দেওয়া একটি আমানত হিসেবে গণ্য করা হয়, তাই এর যথাযথ যত্ন নেওয়া প্রত্যেক মুসলমানের দায়িত্ব। ওজন কম হওয়া যেমন শারীরিক দুর্বলতার কারণ হতে পারে, তেমনি প্রয়োজনীয় পুষ্টির অভাব শরীরকে বিভিন্ন রোগের দিকে ঠেলে দিতে পারে। তাই যারা ওজন বাড়াতে চান, তাদের জন্য ইসলামিক পদ্ধতিতে স্বাস্থ্যকর উপায়ে মোটা হওয়ার কিছু কার্যকর দিকনির্দেশনা রয়েছে।
ইসলামিকভাবে স্বাস্থ্যকর উপায়ে ওজন বাড়ানোর উপায়
৫.১. প্রাকৃতিক সুন্নাহ খাবার গ্রহণ করুন:
ইসলামে কিছু সুন্নাহ খাবার রয়েছে, যা শরীরের পুষ্টি বৃদ্ধিতে সহায়ক।
ইসলামে শরীরের সুস্থতা কামনার জন্য বিভিন্ন দোয়া রয়েছে, যা অনুসরণ করা যেতে পারে।
প্রতিদিন সকালে কাঁচা কলার সঙ্গে দুধ খেলে দ্রুত ওজন বাড়ে। ঘি ও চিনি একসঙ্গে মিশিয়ে খেলে ওজন দ্রুত বাড়তে সাহায্য করে। এছাড়া কিসমিস ও বাদাম ভিজিয়ে খেয়ে শরীরের শক্তি বৃদ্ধি করা সম্ভব।
শুধু খাবার খেলেই ওজন বাড়বে না, শরীরের আকৃতি সুন্দর করতে ব্যায়াম করতে হবে। ওজন বাড়ানোর জন্য ভারোত্তোলন বা ওজন তোলা (Weight Training), স্কোয়াট, পুশ-আপ, লেগ প্রেস এবং যোগব্যায়াম করতে পারেন।
পর্যাপ্ত বিশ্রাম না নিলে শরীর ক্যালোরি সংরক্ষণ করতে পারে না, ফলে ওজন কমে যায়। প্রতিদিন কমপক্ষে ৭-৮ ঘণ্টা ঘুমান এবং মানসিক চাপ থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করুন।
অনেক সময় হরমোনজনিত সমস্যা, যেমন- থাইরয়েড বা ডায়াবেটিসের কারণে ওজন কমে যায়। যদি কোনো দীর্ঘস্থায়ী রোগ থাকে, তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।
অনেকেই দ্রুত মোটা হওয়ার জন্য বাজারের কিছু ঔষধ বা সাপ্লিমেন্ট ব্যবহার করেন, তবে এটি স্বাস্থ্যকর উপায় নয়। কিছু কার্যকর সাপ্লিমেন্ট আছে যা ব্যবহার করতে পারেন- প্রোটিন পাউডার, ওজন বাড়ানোর গেইনার (Weight Gainer) এবং মাল্টিভিটামিন সাপ্লিমেন্ট। তবে যেকোনো ওষুধ বা সাপ্লিমেন্ট গ্রহণের আগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
ওজন বাড়ানোর জন্য স্বাস্থ্যকর চর্বি খাওয়া জরুরি। যেমন-অলিভ অয়েল, নারিকেলের তেল, বাদাম বা চিনাবাদাম, মাখন, এভোকাডো, দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার।
ওজন বাড়ানোর জন্য পানি পান করা জরুরি, তবে খাবারের সঙ্গে বেশি পানি পান করলে খাবারের প্রতি আগ্রহ কমে যেতে পারে। তাই খাবার খাওয়ার অন্তত ৩০ মিনিট পর পানি পান করুন।
উপরের নিয়মগুলো অনুসরণ করলে দ্রুত ওজন বাড়ানো সম্ভব, তবে তা অবশ্যই স্বাস্থ্যকর উপায়ে হতে হবে। যেকোনো ডায়েট বা জীবনযাত্রার পরিবর্তনের আগে একজন পুষ্টিবিদের পরামর্শ নেওয়া ভালো।
ওজন বাড়ানোর জন্য শুধুমাত্র বেশি খাওয়া যথেষ্ট নয়, বরং সঠিক খাদ্যাভ্যাস গড়ে তোলা জরুরি। একটি পরিকল্পিত ডায়েট চার্ট অনুসরণ করলে স্বাস্থ্যকরভাবে ওজন বাড়ানো সম্ভব। নিচে একটি আদর্শ ওজন বাড়ানোর ডায়েট চার্ট দেওয়া হলো-
সকালের নাস্তা পুষ্টিকর হলে সারাদিনের শক্তি বজায় থাকে এবং ওজন বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়।
দুপুরের খাবার (দুপুর ১:০০ - ২:৩০)
ওজন বাড়ানোর জন্য নিয়মিত এবং স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়ার পাশাপাশি পর্যাপ্ত ঘুম ও ব্যায়াম করাও জরুরি। এই তালিকা থেকে সুবিধামতো খাবার বেছে নিয়ে আপনার খাদ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন।
ওজন বাড়ানোর সময় কিছু খাবার এড়িয়ে চলা জরুরি, কারণ সেগুলো শরীরের পুষ্টি শোষণে বাধা সৃষ্টি করতে পারে বা হজমের সমস্যা তৈরি করতে পারে।
সঠিকভাবে ওজন বাড়াতে হলে স্বাস্থ্যকর ও পুষ্টিকর খাবারের দিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত এবং এই ক্ষতিকর খাবারগুলো এড়িয়ে চলা ভালো।
ওজন বাড়ানোর জন্য শুধু খাবারই যথেষ্ট নয়, সঙ্গে সঠিক ব্যায়াম করাও জরুরি। সঠিক ব্যায়াম পেশির গঠন বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে এবং শরীরে সুস্থভাবে ওজন বাড়ায়।
প্রতিদিন বা সপ্তাহে অন্তত ৩-৪ দিন এই ব্যায়ামগুলো করলে পেশি বৃদ্ধি পাবে এবং স্বাস্থ্যকর উপায়ে ওজন বাড়বে। তবে ব্যায়ামের পাশাপাশি পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেওয়া ও পুষ্টিকর খাবার খাওয়া জরুরি।
সকালে খালি পেটে প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার যেমন ডিম, দুধ, বা বাদাম খাওয়া উপকারী। এছাড়া কলা, খেজুর এবং শস্যজাতীয় খাবারও ওজন বাড়াতে সাহায্য করে। এসব খাবারে উচ্চ ক্যালোরি এবং পুষ্টি উপাদান থাকে যা ওজন বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
রাতে উচ্চ ক্যালোরি এবং প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার যেমন মুরগির মাংস, ডাল, টক দই, বাদাম, বা স্যুপ খাওয়া যেতে পারে। এছাড়া এক গ্লাস দুধ ওজন বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
ওজন বাড়ানোর জন্য চিকিৎসকের পরামর্শে কিছু ঔষধ যেমন অ্যাপেটাইট স্টিমুল্যান্টস (যেমন, মেগাসিট) বা ভিটামিন সাপ্লিমেন্টস (যেমন, ভিটামিন বি-১২) নেওয়া যেতে পারে। তবে, যেকোনো ঔষধ খাওয়ার আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ।
১ কেজি ওজন বাড়াতে সাধারণত ৭,৭০০ ক্যালোরি অতিরিক্ত গ্রহণ করতে হয়। তবে এটি ব্যক্তি বিশেষে ভিন্ন হতে পারে এবং স্বাস্থ্যকর উপায়ে ওজন বাড়ানোর জন্য সঠিক ডায়েট ও ব্যায়াম জরুরি।
ইসলামে মোটা হওয়ার জন্য কার্যকরী অনেক হাদিস রয়েছে, যা শরীরের সুস্থতা এবং ওজন বৃদ্ধির জন্য সাহায্যকারী। বিশেষত, খেজুর ও শসা একসঙ্গে খাওয়ার বিষয়ে সুন্নাহ রয়েছে। হাদিসে বলা হয়েছে, খেজুর এবং শসা শরীরের পুষ্টি উন্নত করতে সহায়ক। হজরত আয়েশা রা: বর্ণনা করেছেন, তার মা তাকে স্বাস্থ্যবান করে রাসূলুল্লাহ সা: এর কাছে পাঠানোর জন্য নানা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন, কিন্তু কোন ফল পাওয়া যায়নি। শেষে, তিনি তাকে পাকা খেজুরের সাথে শসা খাওয়াতে শুরু করলে, আয়েশা রা: স্বাস্থ্যবান হয়ে ওঠেন। (সুনানে আবু দাঊদ, হাদিস নং ৩৯০৩)। এছাড়া, ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকে সুস্থ শরীর এবং সুস্থ খাদ্যাভ্যাসের জন্য প্রাকৃতিক খাবার গ্রহণ এবং শরীরের যত্ন নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
Was this post helpful?0
0